History

সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম হিসেবে পরিচিত। পূণ্যভূমি সিলেটের ৩৬০ আউলিয়ার  মধ্যে একজন হযরত শাহঃ শামসুদ্দীন (রঃ) এর স্মৃতি বিজরিত গ্রাম সৈয়দপুর। যিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সৈয়দপুর দরগা মসজিদ প্রাঙ্গণে। যার দোয়ার বরকতে এই সৈয়দপুরে জন্ম নিয়েছেন অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গ। 

সৈয়দপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা কোন একক ব্যক্তি নয়; এটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফসল। ১৯৬২-৬৩ সালে সৈয়দপুরের যেসব ছাএ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করতেন, তাদের মধ্যে সৈয়দপুরে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেখা দেয়। এটি ছিল তখন একটি স্বপ্ন। স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে যারা ব্রত হন, তাঁরা কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করেন চিন্তাশীল ব্যক্তি মাত্রই তা অনুধাবন করতে সক্ষম। প্রথম বাস্ত পদক্ষেপ হিসেবে ঐ সময়ে কোন এক বৃষ্টি ভেজা দিনে গয়গড়স্থ ডাঃ মরহুম সৈয়দ আছাব মিয়ার (মাস্টার সৈয়দ আবুল ফজল টুনুর পিতা) বাড়িতে উল্লেখিত ছাত্ররা একটি বৈঠকে মিলিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হন। হাইস্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে সামনে রেখে প্রথম পরামর্শ সভায় ছাত্র ও যুবকরা পোষ্ট অফিস বাড়িতে সৈয়দ আশফাক হোসেন ফারুক (পার্ট সেক্রেটারী, বাংলাদেশ হাই কমিশন, লন্ডন) এর সাথে মিলিত হন। উক্ত সভায় সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ফখরুল, সৈয়দ আব্দুল মালিক, সৈয়দ নজমুল হোসেন, প্রফেসর শেখ মুহাম্মদ আসাদ্দর আলী, সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। 
     পরবর্তীতে উদ্যেক্তা ছাত্রগণ গ্রামের হালিচারা মাঠে সে সময় বি.এ পরীক্ষার্থী জনাব সৈয়দ আব্দুল মালিক (বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক জিএম), তখনকার কলেজ ছাত্র জনাব সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ফখরুল, জনাব মোঃ আব্দুল খালিক (প্রাক্তন চেয়ারম্যান) ও অন্যান্যদের সাথে একটি পরামর্শ সভায় মিলিত হন। উক্ত সভায় সৈয়দ আব্দুল মালিক তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সকল ছাত্রই যাতে প্রস্তাবিত সৈয়দপুর স্কুলে এসে ভর্তি হন তার পরামর্শ দেন। তার প্রেক্ষিতে কিছুদিনের মধ্যেই ছাত্ররা তাদের নিজ নিজ স্কুল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নতুন স্কুলে ভর্তি হতে চলে আসেন। এই সকল ছাত্র সে সময় ছাড়পত্র নিয়ে এসে সৈয়দপুর স্কুলে ভর্তি না হলে স্কুল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হত না। এভাবে ১৯৬৩ সালে ১৩ই মার্চ এক সুন্দর সকালে চৌধুরী বাড়ীর সৈয়দ আজমল আলী সাহেবের বাংলায় স্কুলটি তার শুভ যাত্রা শুরু করে। জানা যায়, স্কুলটি স্থাপিত হওয়ার প্রারম্ভে কোন আর্থিক সহায়তা নেওয়া হয় নাই। সর্বজন সৈয়দ আব্দুল মালিক, মোঃ আব্দুল খালিক, সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ফখরুল ও সৈয়দ তৈমুছ আলী এই চার ব্যক্তি বিনা বেতনে স্কুলে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। প্রথমদিকে শুধু ছাত্রদের বেতন এবং কিছুদিন পর মাসিক এক টাকা করে চাঁদা দিয়ে স্কুলটির যাবতীয় খরচ বহন করা হয়। স্কুল চালু হওয়ার কয়েক মাস পর মরহুম মৌলভী সৈয়দ শফিকুল হক পাইলগাঁও হাইস্কুল থেকে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে সৈয়দপুর জুনিয়র হাইস্কুলে যোগদান করেন। তিনি স্কুল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। স্কুলটির প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে মরহুম সৈয়দ আব্দুল মান্নান মাস্টার সর্ব প্রকার সহযোগিতা করেন। তিনি ছিলেন স্কুল কমিটির প্রথম সেক্রেটারী। আজীবন তিনি স্কুলটির উন্নয়নের জন্য অবদান রেখেছেন। জনাব সৈয়দ আব্দুল মালিক স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন। পূর্বে উল্লেখিত চারজন ব্যক্তি ছাড়াও স্কুল প্রতিষ্ঠা লগ্নে আরো যারা বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন, তাঁরা হলেন মরহুম সৈয়দ কবির আহমদ এডভোকেট, সৈয়দ মোয়াজ্জম হোসেন ব্যাংকার, সৈয়দ নজমুল হোসেন প্রমুখ।  

স্কুলটি ১৯৬৭-৬৮ সালের দিকে চৌধুরী বাড়ি থেকে বর্তমান স্থানে স্থাপিত হয়। স্কুলের বর্তমান স্থানটি নির্ধারণ করেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মরহুম ডঃ আখলাকুর রহমান ও মরহুম সৈয়দ আরজুমন্দ আলী। জন্মলগ্ন থেকে স্কুলটিকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, সৈয়দ আরজুমন্দ আলী তাদের মধ্যে অন্যতম। স্কুলটির সার্বিক উন্নতির পিছনে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি স্কুল কমিটির প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মরহুম সৈয়দ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্ঠায় প্রথম দিকে স্কুলটি সরকারি অনুদান ও সকল প্রকার সাহায্য পেতে থাকে। মরহুম ডাঃ সৈয়দ মহিউদ্দীন (কাচা মিয়া) সাহেব একমাত্র ব্যক্তি যিনি হাইস্কুলে নিজস্ব ভূমি দান করেন। 

১৯৭১ সালে সৈয়দ আরজুমন্দ আলী ও সৈয়দ মুজিবুর রহমানের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফলে স্কুলটি জুনিয়র স্কুল থেকে হাইস্কুলে উন্নীত হয়। ১৯৭১ সালেই প্রথম স্কুল থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করার অনুমতি পায়। তখন থেকে স্কুলটি সৈয়দপুর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিতি লাভ করে। 

বিদ্যলয়ের প্রাক্তন মূল ভবনসমূহ তৈরি হয় তখনকার প্রবাসীদের আর্থিক সহযোগিতায়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাতা হলেন- সৈয়দ মন্তাজ আলী (মন্ত মিয়া), সৈয়দ শামসুল হক (পাখি মিয়া), সৈয়দ আনহার মিয়া প্রমুখ।

পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনসহ পাইলট প্রকল্পের অধীনে অন্যান্য ভবনসমূহ সরকারি অনুদানে স্থাপিত হয়। সরকারি ভবনসমূহ প্রাপ্তিতে তখন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন সৈয়দ জগলুল পাশা (সিঃ সহঃ সচিব)। অতপর ১৯৮৬ সালে পাইলট প্রকল্পের অন্তভূক্ত হওয়ায় বিদ্যালয়টির নামকরণ হয় “সৈয়দপুর পাইলট উচ্চ ‍বিদ্যালয়” এবং পাইলট প্রকল্পের অধীনে একটি দ্বি-তল ভবন নির্মিত হয় ১৯৮৭-৮৮ সালে। তখন থেকে “সৈয়দপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়” নামটি শিক্ষা মন্ত্রনালয়সহ সর্বমহলে পরিচিতি লাভ করে। 

অত্র বিদ্যালয়ে ১৯৯৪ সালে “বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়” পরিচালিত এসএসসি প্রোগ্রামের যাত্রা শুরু হয়। এখান থেকে প্রতিবছর ঝড়ে পড়া অনেক শিক্ষার্থী এসএসসি পাশ করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। জগন্নাথপুর উপজেলায় এটি একমাত্র বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রামের টিউটোরিয়াল এবং পরীক্ষা কেন্দ্র। 

পরবর্তীতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে একটি বহুতল ভবন নির্মিত হয়। একই বছর বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল থেকে একটি ভাচুয়াল কম্পিউটার ল্যাব শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্থীদের আধুনিক তথ্য প্রযুক্তিতে একধাপ এগিয়ে চলতে সহায়তা করে যাচ্ছে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের ম্যানেজিং কমিটি এবং এলাকার বিত্তশালী ব্যক্তিদের আর্থিক সহায়তায় বিদ্যালয়ের ৩৭৫ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৫৫ ফুট প্রস্থ সীমানা প্রাচীর নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। 

বর্তমানে ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে আরও একটি বহুতল ভবনের কাজ সমাপ্তির দিকে। বিদ্যালয়ের পশ্চিম দিকে ৈএ বহুতল ভবনটির কাজ সমাপ্ত হলে “সৈয়দপুর পইলট উচ্চ বিদ্যালয়” হবে আবাসনের দিক থেকে স্বয়ংসম্পন্ন একটি আকর্ষণীয় বিদ্যালয়। 

বিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে বর্তমান প্রধান শিক্ষক জনাব সৈয়দা নুরুন নাহার এবং বিদ্যালয়ের নিয়মিত ব্যবস্থাপনা কমিটির সম্মাণিত সভাপতি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মরহুম জনাব আরজুমন্দ আলীর সুযোগ্য পুত্র জনাব সৈয়দ রশীদ আহমদ এহসান, শিক্ষানুরাগী সদস্য জনাব সৈয়দ শাহ কামাল চৌধুরী, অভিভাবক সদস্য জনাব সৈয়দ মশহুর আলী প্রমুখ নিরলস ভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। 


তথ্যসূত্রঃ সৈয়দপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।